Thursday, October 26, 2017

জগদ্ধাত্রী পুজার ইতিহাস


জগদ্ধাত্রী পুজার ইতিহাস

জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালী পূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হত।
কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা সম্পাদনা
কৃষ্ণনগর রাজবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজা
নদিয়া জেলার সদর কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
কিংবদন্তী অনুসারে নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজার নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর দুর্গাপূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী দুর্গার পূজা করার আদেশ দেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ১৭৬৬ সালে। কেউ কেউ আবার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা জগদ্ধাত্রী পূজার সময় আজও খোলা থাকে। পূজা পুরনো প্রথা মেনে হয় শুধুমাত্র নবমী তিথিতে।
১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনায় গয়নায় দেবীপ্রতিমার অলংকারসজ্জা। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা; তাঁর নিকট সকল মনোষ্কামনাই পূর্ণ হয়।
এছাড়াও বর্তমানে কৃষ্ণনগরে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা হয় দুই শতেরও বেশি, যা জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য বিখ্যাত চন্দননগর মহানগরের চেয়েও বেশি। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। তবে এখন ঘটা করে জগদ্ধাত্রী পুজা
হয়ে থাকে।

Friday, October 13, 2017

রামপ্রসাদের সাধনপীঠ


রামপ্রসাদের সাধনপীঠ সম্পর্কে আলোচনা করার আগে কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত। প্রসঙ্গত সাবর্ণ বংশের লক্ষ্মীকান্তের প্রপৌত্র পঁচিশতম পুরুষ রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরী(জন্ম ১৬৫২ খ্রিঃ) পরমসিদ্ধ তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরী কুমারহট্ট হাভেলিশহরে( হালিশহরে) সাধনপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। সাধনপীঠ প্রতিষ্ঠা করা মোটেই সহজ কাজ নয়। এরজন্য পঞ্চবট, পঞ্চমুণ্ডের আসন স্থাপন করতে হয়। কোটিবার মহাবিদ্যার বীজমন্ত্র জপ করা, কোটিবার হোমযজ্ঞ সম্পন্ন করা হলেই তবে আসনটি পীঠাসনে পরিণত হয়। শাক্ত তান্ত্রিক রামকৃষ্ণ এই নিয়মেই সিদ্ধপীঠ রচনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর নাম অনুসারে সিদ্ধপীঠটি "রামকৃষ্ণ মণ্ডপ" নামে আখ্যা লাভ করে।
Ramprasad sen png photo
 কুমারহট্ট হালিশহরে এরপর আরেকজন মহাসাধকের জন্ম হয়। তিনি প্রখ্যাত সাধক রামপ্রসাদ সেন (জন্ম ১৭২০)। রামপ্রসাদ জন্মসূত্রে বৈদ্য, শাক্ত কালীভক্ত ছিলেন। সঙ্গীতের কথা ও সুরের মাধ্যমে কালীমাতার সঙ্গে যেন সংলাপ করতেন। রামপ্রসাদের সাধনা ও কবিত্ব মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় হালিশহরের সাবর্ণ বংশের জমিদাররা ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রামপ্রসাদকে কৃষিযোগ্য জমি, বাস্তুভিটাসহ রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সিদ্ধপীঠ দান করেন। ক) সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশীয় দর্পনারায়ণ, শ্রীরাম রায়, কালীচরণ রায়- তিনজনে একত্রে মোট ৮ বিঘা জমিদান করলেন। তারিখ ২এপ্রিল, ১৭৫৪ খ) হালিশহরের সাধক রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ সুভদ্রাদেবীর অপুত্রক থাকায় ' সবৃক্ষবাটি আন্দাজ ১বিঘা জমি রামপ্রসাদকে বসবাস ও সাধনার জন্য দান করেন। তারিখ- ১৫ ই এপ্রিল, ১৭৫৮ গ) সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশীয় দর্পনারায়ণ এককভাবে ২বিঘা জমি দান করেছিলেন। তারিখ- ১লা জুলাই, ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে অনেকের মতে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার থেকেই তাকে "কবিরঞ্জন" উপাধি প্রদান করা হয়। সাধক রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ সুভদ্রাদেবী কর্তৃক তাঁর শ্বশুরের নির্মিত "রামকৃষ্ণধাম" রামপ্রসাদ সেন দানস্বরূপ ১৫ই এপ্রিল,১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে পান। কালীমাতা রামপ্রসাদের পত্নীকে উক্ত সাধনপীঠে সাধনা করতে বলেন।সেই সাধনায় রামপ্রসাদ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। উক্তধামের সেই পঞ্চবটীতলা এবং পঞ্চমুণ্ডাসন আজও বর্তমান। রামপ্রসাদ সেনের তিরোধানের পরে প্রায় ষাটবছর জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। পরে উদ্দোগ নিয়ে স্থানটিকে দর্শনযোগ্য তীর্থস্থানে পরিণত করা হয়েছে।


সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের উল্লেখযোগ্য তন্ত্রসাধক রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সাধন প্রেরণা এবং তাঁর নির্মিত পঞ্চবটীতলা ও পঞ্চমুণ্ডাসনের কথা সাধক রামপ্রসাদ সেন তাঁর "বিদ্যাসুন্দর" কাব্যে উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে এই মহাপ্রাপ্তি যে তাঁর সিদ্ধিলাভের অনুকূল ও সহায়ক হয়েছে তাও স্বীকার করেছেন। কথিত আছে, সাধক রামপ্রসাদ সেন ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কালীপুজোর পরদিন ভোরে গঙ্গায় কালীমাতার মূর্তি বিসর্জন দেওয়ার কালে গঙ্গাবক্ষে বিলীন হয়ে যান। কিন্তু তাঁর তিরোধানের সময়টি সঠিক নয়। কারণ নীচের উল্লেখিত দস্তখৎ প্রমাণ করে যে তিনি ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ফলে তাঁর তিরোধান ঘটে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে বা তার পরে। ১২০১ বঙ্গাব্দের, বৈশাখমাসে (ইং এপ্রিল,১৭৯৪) হালিশহরের সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের এক কবুলতি পত্রে ইসাদী হিসাবে সাধক রামপ্রসাদ সেনের দস্তখৎ। সুতরাং ১৭৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৭৪-৭৫ বছর বয়সের মধ্যে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। উক্ত কবুলতি পত্র বড়িশায় সাবর্ণদের সংগ্রহশালাতে রয়েছে।

জগদ্ধাত্রী পুজার ইতিহাস

জগদ্ধাত্রী পুজার ইতিহাস জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালী পূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষ...